ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০২০ সাল। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল ২8টি বছর। কত মধুর স্মৃতি জমা হয়েছে স্মৃতির পাতায়। স্মৃতির পাতা যেন বার বার শৈশবে ডাক দিয়ে যায়।
মনে পড়ে মায়ের হাতের মার খাওয়ার কথা। আমার একটা বদ অভ্যাস ছিল যে, আম্মু বাড়ির বাইরে দুরে কোথাও যেখানে যাবে আমাকে নিয়ে যাবে। না নিয়ে গেলে শুরু হতো দুষ্টামি। কেন তুমি আমাকে নিয়ে যাওনি। আর এজন্যই মায়ের হাতে মার খেতাম প্রতিনিয়ত।
আমি ছিলাম ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। তাই সবার কাছ থেকে অনেক অনেক আদর পেতাম। বিশেষ করে সেই সময়ের ঈদ গুলো কাটল অনেক আনন্দে। ঈদের আগের রাতে বোনেরা গাছ থেকে টাটকা মেহেদি তুলে পাটায় বেটে হাতে লাগানোর জন্য বলত আমি লাগাতে চাইতাম না। আমার কাছে কেমন যেন ঝামেলা মনে হতো। তারপরও যখন রাতে ঘুমিয়ে যেতাম সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে দেখতাম আমার হাতে মেহেদি। তখন মনটা অনেক আনন্দে ভরে যেত। আজ তারা সবাই আপন আপন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর ঈদের জামা-কাপড় যতদিন আগেই কেনা হোক না কেন সেগুলো কাউকে দেখাতাম না, পুরানো হয়ে যাবে তাই। আজও সেগুলো স্মৃতির পাতায় দাগ কেটে যায়।
আজ মনে হয় এইতো সেদিন বাবা আমাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। কেউ একজন পাস থেকে আব্বুকে সালাম দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছেন; আব্বু বলল তোমাদের ভাইকে বাধতে যাচ্ছি। যে বলেছিল সে আমার সম্পর্কে ভাই ছিলেন তবে কে ছিলেন তা মনে নেই।
সেটি ছিল ১৯৯৮ সাল। সে বছর ইতিহাসের ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। স্কুলে ভর্তির কয়েকদিন পরেই বন্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আর বানভাসী সব মানুষ গুলো আমাদের স্কুলে উঠে শুরু করে। আমাদের স্কুল ছুটি ঘোষনা করা হয়।
মনে পড়ে সেই বয়াল বন্যার কথা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আমাদের আশ-পাশের সকল মানুষ তাদের বাড়ি অন্যত্র চলে গেলও আমরা যায়নি। সারাদিন বানের পানিতে চলত ডুব-সাতার। আম্মুর বকুনি খেয়ে উঠতাম গোসুল সেরে। আমাদের বাসার সামনে থাকত পারাপারের নৌকা। সেই নৌকায় সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। বন্যা নেমে গেল শুরু হল স্কুল। শুরু হল জীবনের পথচলা।
২০০৩ সাল প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। সাল ছিল আমাদের পরিবারের জন্য বিভীষিকা। গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার বাবার ডান হাত টা চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যায়। আমাদের সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল সেই দিন। শুরু হয় সংসারে টানা-পড়া। বড় ভাই হয়ে গেলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় গুটিগুটি পায়ে চলতে থাকে আমার পড়া লেখা। আশে-পাশে তৈরি হতে থাকে বন্ধুদের সার্কেল। সারাদিন ক্লাস শেষে দুপুরে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে আবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা শেষে বাড়ি ফেরা। অবশ্য এটা নিয়ে আম্মুর অনেক অভিযোগ ছিল । আমাকে পরিবারের সবাই এতটায় ভালোবাসত যে আম্মুর এ সব অভিযোগ কেউ কানেই তুলতো না। এক-দুই-তিন করে কেটে যায় আরও পাচটি বছর। দরজায় কড়া নাড়ছে এসএসসি পরীক্ষা। সবাই আমাকে যতোই ভালবাসুক না কেন? লেখা-পড়ার কাছে কোন আপোষ ছিল না। তাই মাথায় একটা চাপ নিয়ে পড়া-লেখা শুরু করলাম মন দিয়ে। পরীক্ষা দিলাম সবার দোয়ায় রেজাল্ট ভালই হলো।
এইচিএসসিতে ভর্তি হলাম। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ভালই কাটছে সময়। একবছর পার হয়ে গেল। ২০১০ বড় ভাইয়া একটা মোবাইল কিনে দিল । তখন কিযে খুশি। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সাথে আর বললেন এইচএসসিতে ভাল করতে হবে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। মাথায় চাপ অারো বেড়ে গেল। এইচএসসি পরীক্ষা হল। এখন আর কোন পড়া লেখা নেই তাই পরিবারকে একটু সাহায্য করার জন্য আমিও বিভিন্ন কাজ করতে লাগলাম। ফলে আমি লেখা-পড়া থেকে অনেক দূরে চলে গেলাম। অবশেষে রেজাল্টও ভালই হলো। লেখা-পড়ার কাছে না থাকায় পাবলিক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলো না। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হলাম। শেসন জোটের কবলে পড়ে চার বছরের কোর্স ছয় বছরে শেষ করলাম।
জীবন পরিক্রমায় এতগুলো সময় নিশব্দে চলে গেল আমি বুঝতেও পারি নি। মনে হলো আমি স্বপন দেখছি নাতো। আজ সম্ভব হলে আরেকবার যদি শৈশবের সেই স্মৃতিময় দিনগুলো ফিরে যেতে পারতাম। তাহলে আবার শৈবের সেই সুধা পান করে ধন্য হতাম আরেকবার।
No comments:
Post a Comment